Table of Contents
রচনা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল/কর্ণফুলি টানেল
যোগাযোগব্যবস্থার মাইলফলক ভূমিকা :
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল বা কর্ণফুলী টানেল (সুড়ঙ্গ সড়ক) হলো কর্ণফুলী নদীর নিচে অবস্থিত নির্মাণাধীন সড়ক। এই সুড়ঙ্গটি কর্ণফুলী নদীর দুই তীরের অঞ্চলকে যুক্ত করবে। টানেল চালু হলে বাণিজ্যিক যোগাযোগব্যবস্থায় বৈপবিক পরিবর্তন আসবে। টানেলকে ঘিরে দেশের নতুন অর্থনৈতিক সম্ভাবনার দুয়ার খুলবে। সেই সঙ্গে হাজারো সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে বলে সকলের প্রত্যাশা।
টানেল পরিচিতি :
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল বা কর্ণফুলী টানেল চার লেনবিশিষ্ট। দুটি টিউবসংবলিত ৩ দশমিক ৪ কিলোমিটার কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে এই টানেল নির্মিত হচ্ছে। চট্টগ্রাম শহরপ্রান্তের নেভাল একাডেমির পাশ দিয়ে শুরু হওয়া এই সুড়ঙ্গ নদীর দক্ষিণ পাড়ের সিইউএফএল (চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেড) এবং কাফকো (কর্ণফুলী ফার্টিলাইজার লিমিটেড) কারখানার মাঝামাঝি স্থান দিয়ে নদীর দক্ষিণ প্রান্তে পৌঁছাবে। কর্ণফুলী নদীর মধ্যভাগে সুড়ঙ্গ অবস্থান করবে ১৫০ ফুট গভীরে। নদীর তলদেশে প্রতিটি টিউব চওড়া ১০ দশমিক ৮ মিটার বা ৩৫ ফুট এবং উচ্চতা ৪ দশমিক ৮ মিটার বা অন্তত ১৬ ফুট। একটি টিউব থেকে অপর টিউবের পাশাপাশি দূরত্ব প্রায় ১২ মিটার। টানেলের প্রস্থ ৭০০ মিটার এবং দৈর্ঘ্য ৩ হাজার ৪০০ মিটার। সুড়ঙ্গটির মূল দৈর্ঘ্য ৩.৪৩ কিলোমিটার হলেও এর সঙ্গে ৫ কিলোমিটারের বেশি সংযোগ সড়ক (অ্যাপ্রোচ রোড) যুক্ত হবে।
টানেলের পশ্চিম ও পূর্ব প্রান্তে ৫ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার এপ্রোচ রোড এবং ৭২৭ মিটার ওভার ব্রিজসম্পন্ন টানেলটি চট্টগ্রাম শহরের সঙ্গে আনোয়ারা উপজেলাকে সংযুক্ত করবে। প্রকল্পের ফিজিবিলিটি স্টাডি প্রতিবেদন অনুযায়ী, কর্ণফুলী টানেল চালুর প্রথম বছর ৬৩ লাখ গাড়ি টানেলের নিচ দিয়ে চলাচল করবে। যেটি ক্রমান্বয়ে বাড়তে বাড়তে দেড় কোটিতে গিয়ে দাঁড়াবে। চালুর প্রথম বছরে চলাচলকারী গাড়ির প্রায় ৫১ শতাংশ হবে কনটেইনার পরিবহনকারী ট্রেইলর এবং বিভিন্ন ধরনের ট্রাক ও ভ্যান। বাকি ৪৯ শতাংশের মধ্যে ১৩ লাখ বাস ও মিনিবাস। আর ১২ লাখ কার, জিপ ও বিভিন্ন ছোট গাড়ি চলাচল করবে। এই সুড়ঙ্গের মধ্য দিয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক যুক্ত হবে। এই সুড়ঙ্গটি নির্মাণ হলে এটিই হবে বাংলাদেশের প্রথম সুড়ঙ্গ পথ এবং দক্ষিণ এশিয়ায় নদী তলদেশের প্রথম ও দীর্ঘতম সড়ক সুড়ঙ্গপথ।
চানেল নির্মাণের ইতিহাস :
কর্ণফুলী নদী দেশের বাণিজ্যিক নগরী চট্টগ্রামকে দুইভাগে বিভক্ত করেছে। এই নদীর উপর ইতোমধ্যে তিনটি সেতু নির্মিত হলেও স্বরপূর্ণ এ অঞ্চলের জন্য তা যথেষ্ট নয়। এ ছাড়া কর্ণফুলী নদীর উপর সেতু নির্মাণে তলদেশে পলি জমে সমস্যা তৈরি করে, যা চট্টগ্রাম বন্দরের জন্য বড় হুমকি। এই সমস্যার মোকাবিলায় কর্ণফুলীতে নতুন কোনো সেতু নির্মাণ না করে তলদেশে টানেল নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়। ২০০৮ সালে কর্ণফুলী নদীর ভলদেশে দেশের প্রথম টানেল নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরে টানেল নির্মাণের জন্য ২০১৪ সালের ১০ জুন প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে বেইজিংয়ে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। পরে ২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবরে চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিনপিং প্রকল্পের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। এরপর ২০১৯ সালে ২৪ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় টানেল প্রকল্প এলাকার কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ডে সুইচ টিপে আনুষ্ঠানিকভাবে খননকাজের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী।
টানেল নির্মাণের চুক্তি ও ব্যয় :
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল প্রকল্পটি বাংলাদেশ ও চীন সরকারের (জি টু জি) যৌথ অর্থায়নে সেতু কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে বাস্তবায়ন হচ্ছে। ২০১৬ সালের অক্টোবর মাসে চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিনফিংয়ের ডাকা সফরে টানেল নির্মাণে ঋণ চুক্তি স্বাক্ষর হয়। প্রকল্পটির মোট ব্যয় ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি ৪২ লাখ টাকা ধরা হয়। এর মধ্যে চুক্তি অনুযায়ী চীনের এক্সিম ব্যাংক ২০ বছর মেয়াদি ঋণ হিসেবে ৫ হাজার ৯১৩ কোটি টাকা দিচ্ছে এবং বাংলাদেশ সরকার দিচ্ছে ৪ হাজার ৪৬১ কোটি ২৩ লাখ টাকা। চীনের কমিউনিকেশন ও কনস্টাকশন কোম্পানি লিমিটেড (সিসিসিসি) টানেল নির্মাণের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজটি বাস্তবায়ন করছে।
টানেল নির্মাণ প্রকল্পের উদ্দেশ্য :
বাংলাদেশ একটি নদীমাতৃক দেশ। কর্ণফুলী নদী চট্টগ্রাম শহরকে দুই ভাগে বিভক্ত করেছে। এক ভাগে রয়েছে নগর ও বন্দর এবং অপর ভাগে রয়েছে ভারী শিল্প এলাকা। কর্ণফুলী নদীর উপর ইতোমধ্যে ৩ (তিন)টি সেতু নির্মিত হয়েছে, যা বিরাজমান প্রচুর পরিমাণ যানবাহনের জন্য যথেষ্ট নয়। নদীর মরফলজিক্যাল বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী কর্ণফুলী নদীর তলদেশে পলি জমা একটি বড় সমস্যা এবং চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যকারিতার জন্য বড় হুমকি। এই নির্মাণ না করে এর তলদেশে টানেল নির্মাণ করা প্রয়োজন। এ জন্য সরকার পলি জমা সমস্যার মোকাবেলা করার জন্য কর্ণফুলী নদীর উপর আর কোনো সেতু চট্টগ্রাম জেলার দুই অংশকে সংযুক্ত করার জন্য কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
চট্টগ্রাম হলো বাংলাদেশের প্রধান সমুদ্র বন্দর এবং বৃহত্তম বাণিজ্যিক নগরী। কর্ণফুলী নদীর মুখে অবস্থিত চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমেই অধিকাংশ দেশের আমদানি এবং রপ্তানি কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়। প্রস্তাবিত টানেল চট্টগ্রাম বন্দর নগরকে কর্ণফুলী নদীর অপর অংশের সাথে সরাসরি সংযুক্ত করবে এবং পরোক্ষভাবে ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের মাধ্যমে সারা দেশের সাথে সংযুক্ত করবে। টানেল নির্মাণে প্রধান কারণগুলো হলো-
- চট্টগ্রাম শহরে নিরবচ্ছিন্ন ও যুগোপযোগী সড়ক যোগাযোগব্যবস্থা গড়ে তোলা
- বিদ্যমান সড়ক যোগাযোগব্যবস্থার আধুনিকায়ন । এশিয়ান হাইওয়ের সাথে সংযোগ স্থাপন ।
- কর্ণফুলী নদীর পূর্ব তীর ঘেঁষে গড়ে ওঠা শহরের সাথে ডাউন টাউনকে যুক্ত করা এবং উন্নয়নকাজ ত্বরান্বিতকরণ।
- চট্টগ্রাম পোর্টের বিদ্যমান সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধিকরণ এবং প্রস্তাবিত গভীর সমুদ্র বন্দরের নির্মাণকাজ ত্বরান্বিতকরণ।
- ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজারের মধ্যে নতুন একটি সড়ক যোগাযোগব্যবস্থা গড়ে তোলা। কর্ণফুলী টানেল নির্মিত হলে চীনের সাংহাই শহরের মতো চট্টগ্রাম শহরকে ওয়ান সিটি টু টাউন’ মডেলে গড়ে তোলা হবে।
অর্থনৈতিক সম্ভাবনা :
টানেল প্রকল্পকে ঘিরে দক্ষিণ চট্টগ্রামে ইকোনমিক জোনসহ বিশাল অর্থনৈতিক কর্মযজ্ঞ চলছে। চট্টগ্রামের আনোয়ারায় অবস্থিত কোরিয়ান রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চল (কেইপিজেড), বেসরকারি খাতে সবচেয়ে বড় সার কারখানা (কাফকো), চট্টগ্রাম ইউরিয়া সার কারখানা লিমিটেডে (সিইউএফএল) এবং চট্টগ্রাম বন্দর কার্যক্রম সম্প্রসারণ করা হচ্ছে। এ ছাড়া কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার মাতারবাড়ীতে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগে কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র, এলএনজি স্টেশনসহ বহুবিধ শিল্পকারখানা গড়ে উঠছে। মিয়ানমার হয়ে প্রস্তাবিত এশিয়ান হাইওয়ের সঙ্গে সংযুক্তিসহ ৭টি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছে টানেল নির্মাণের কাজ।
টানেল নির্মাণে চট্টগ্রাম শহরসহ সারাদেশের সঙ্গে দক্ষিণ চট্টগ্রামের তথা কক্সবাজার-টেকনাফ পর্যন্ত যোগাযোগব্যবস্থার সহজতর করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। মূলত টানেলকে ঘিরে চীনের সাংহাই সিটির মতো চট্টগ্রামে গড়ে তোলা হচ্ছে ওয়ান সিটি টু টাউন’ । এতে উন্মোচিত হতে যাচ্ছে নতুন অর্থনৈতিক সম্ভাবনার দ্বার। যার ফলে এ অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রা বদলে যাবে। কর্ণফুলী টানেল নির্মিত হলে এলাকার আশপাশে শিল্পোন্নয়ন, পর্যটন শিল্পের বিকাশ এবং যোগাযোগব্যবস্থার কারণে ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে এবং রপ্তানি বৃদ্ধি পাবে। ফলে দারিদ্র্য দূরীকরণসহ দেশের ব্যাপক আর্থসামাজিক উন্নয়ন সাধিত হবে। ডিপিপি অনুযায়ী, প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে ফিন্যান্সিয়াল ও ইকোনোমিক আইআরআর-এর পরিমাণ দাঁড়াবে যথাক্রমে ৬ দশমিক ১৯ শতাংশ এবং ১২ দশমিক ৪৯ শতাংশ। এ ছাড়া ফিন্যান্সিয়াল ও ইকোনোমিক ‘বেনিফিট কস্ট বেশিও (বিসিআর)’-এর পরিমাণ দাঁড়াবে যথাক্রমে ১ দশমিক শূন্য ৫ এবং ১ দশমিক ৫। ফলে টানেলটি নির্মিত হলে জিডিপিতে ব্যাপক ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
টানেলের বর্তমান অবস্থা :
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের চট্টগ্রামের পতেঙ্গা প্রান্ত থেকে কর্ণফুলী নদীর তলদেশ হয়ে নদীর ওপারে আনোয়ারা পর্যন্ত একটি টিউব স্থাপন শেষ হয় ২০২০ সালের নভেম্বরে। পরে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে শুরু হয় দ্বিতীয় টিউব স্থাপনের কাজ। যা শেষ হয়েছে ৮ অক্টোবর, ২০২১। আনোয়ারা প্রান্ত থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত দ্বিতীয় টিউব স্থাপনের কাজ শেষে উভয়মুখী ৪টি মুখ খুলে দেওয়া হয়। এর মাধ্যমে দুটি টিউবের ভেতর দিয়ে প্রকল্প কাজে নিয়োজিতরা এপার-ওপার চলাচল করতে পারছে। এর আগে স্থাপন শেষ হওয়া প্রথম টিউবের ভেতর দিয়ে চলছে পিচ ঢালা সড়ক নির্মাণের কাজ। দ্বিতীয় টানেলেও সড়ক নির্মাণ শুরু হয়েছে। দুটি টিউবে নির্মাণ হবে ৪ লেনের সড়ক।
করোনা পরিস্থিতির মধ্যে কাজের গতি কিছুটা শ্লথ থাকলেও বর্তমানে চীনের প্রকৌশলীদের তত্ত্বাবধানে দ্রুত গতিতে কাজ এগিয়ে চলছে। কাজে বাড়তি জনবল নিয়োগ করা হয়েছে এবং অত্যাধুনিক নানা যন্ত্রপাতি, মেশিনারিজ সংযুক্ত করা হয়েছে। ফলে কাজের গতি বেড়েছে। প্রকল্পের কাজ ২৪ ঘণ্টাই চলছে। আগামী বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে কর্ণফুলী টানেলের ভেতর দিয়ে গাড়ি চলাচলের লক্ষ্য নিয়ে কাজ এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে।
কবে চালু হবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল :
আগামী ২০২২ সালের মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল বা সুড়ঙ্গটির নির্মাণ শেষ হয়ে তা ব্যবহারের জন্য খুলে দেয়া হবে বলে সরকারিভাবে জানানো হয়েছে।
উপসংহার :
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলকে ঘিরে বন্দরনগরী চ নতুন অর্থনৈতিক সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হতে যাচ্ছে। পাশাপাশি এই যোগাযোগব্যবস্থায় এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। সুফল ভোগ করবে দেশবাসী। এখন অপেক্ষা কেবল শুভ উদ্বোধনের।